ভাত দেয়ার কাইও নাই- ‘ম্যালা দিন থাকি অ’সুখত পড়ি আছং, ভাত নাই ওষধও নাই। বালারচরত মোক চারটে ভাত দেয়ার কাইও নাই। কেমন করি বাছং বাহ।’ কা’ন্নাজ’ড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজে’লার হাতিয়া ইউনিয়নের ৮২ বছরের নিঃসন্তান বৃদ্ধা কাচুয়ানী বেওয়া।
জানা গেছে, গত ২৩ বছর পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের করাল গ্রাসে ভিটেমাটি হারিয়ে তিনি আশ্রয় নেন হাতিয়া বাঁধ রাস্তায়। এর কয়েক বছর পর স্বামী মা রা যায়। শেষ আশ্রয় হয় বালারচর গ্রামে হ’তদরিদ্র দিনমজুর ভাগনা আব্দুস সামাদের বাড়িতে। এরপর জীবন চলে ভিক্ষাবৃত্তি করে।
প্রতিদিন মানুষের বাড়িতে ভিক্ষা করে যা আয় হত তা দিয়েই কোনমতে জীবন চলত তার। কিন্তু চার বছর পূর্বে ভিক্ষা করতে গিয়ে আকস্মিক সড়ক দুর্ঘ’টনায় জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। এরপর খেয়ে না খেয়ে ভা’ঙা ঝুপড়ি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করেন কাচুয়ানী বেওয়া।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকালে জে’লার উলিপুর উপজে’লার হাতিয়া ইউনিয়নের বালাচর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ভাগনা আব্দুস সামাদের বাড়ির পিছনের জঙ্গলে জ’রাজী’র্ণ চারটি টিনের চালার ঝুপড়িতে শুয়ে আছেন ওই বৃদ্ধা। সেখানে বিছানা হিসেবে একটি ভা’ঙা চৌকি, ভা’ঙা চাটাইয়ের বেড়ায় কাঁথা, বালিশ ও মশারি ছাড়াই অ’সহনীয় মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। সামান্য বৃষ্টিতেই ভিজে যায় বিছানা।
এ সময় তাঁর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, কত নিম্বর চেয়ারম্যানের কাছে গেছনু কোনদিন একনা কিছু দেয় নাই মোক। ভাতা কার্ডের জন্য ট্যাহা নাগে। মুই কি খাইম, মোক কাইও ভাত দেয় না। গত বুধবার বিকেলে স্থানীয় কয়েকজন উদ্যমী যুবক কাচুয়ানীকে খাদ্য সহায়তার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে টনক নড়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির।
আব্দুস সামাদ বলেন, আমি গরীব মানুষ, দিন এনে দিন খাই। খালার কোনো সন্তান না থাকায় আমা’র বাড়িতে জায়গা দিয়েছি। তার একটি ভাতা কার্ডের জন্য মেম্বার চেয়ারম্যানের কাছে কত ঘুরছি তবুও তাদের মন গলেনি।
এ বিষয়ে হাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, এর আগে আমা’র কাছে কেউ আসেনি। বিষয়টি ফেসবুকে দেখার পর রাতেই তার জন্য ২০ কেজি চাল পাঠিয়েছি। আজ (বৃহস্পতিবার) একটি মশারি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও তালিকা পাঠানো হয়েছে। তবুও চলতি তালিকায় তাকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হবে।
ভাত খাওয়ার জন্য বারবার আর্তনাদ করছে আনুমানিক ৫ বছর বয়সী একটি ছে’লে শি’শু। ক্ষুধার্ত ছে’লেটি সেই হাঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে বার বার। একটু পর পর দৌড়ে গিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের কাছে ‘ভাত রান্না হতে দেরি হচ্ছে কেন, কখন ভাত খেতে পারবে’ বলে তা জানতে চাইছিল। ‘এই তো, এক্ষুণি হয়ে যাবে’ বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তার মা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। গতকাল বুধবার শেষ বিকেলে সরে জমিন পরিদর্শনকালে রাজধানীর নীলক্ষেত থেকে কাঁ’টাবনগামী রাস্তা প্রায় জনমানবশূন্য দেখা যায়। মাঝে মাঝে সাইরেন বাজিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স ও হাতে-গোনা কয়েকটি প্রাইভেট’কার, মোটরসাইকেল ও রিকশা।
রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী ও পু’লি’শের গাড়ি। নীলক্ষেত ঢালের পাশে ফুটপাত সংলগ্ন ফাঁকা রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটির নিচে তিনটি ইট বসিয়ে চুলা বানিয়ে ভাত চড়িয়েছেন হতদরিদ্র শেফালি বেগম। ঢাকা শহরে নিজের ঘর-বাড়ি নেই। ফুটপাতেই প’ঙ্গু স্বামী ও পাঁচ বছর বয়সী ছে’লেকে নিয়ে দিন কাটে তার।
স্বাভাবিক সময়ে কাঁ’টাবন মোড়ে কখনও ভিক্ষা করে কখনও লুচনি বিক্রি করে সংসার চালান। ক’রোনা’ভাইরা’স সং’ক্র’মণ প্রতিরো’ধে সরকারি টানা ছুটি ও রাস্তাঘাটে মানুষ না থাকায় আয়-রোজগার নেই। ফলে গত কয়েক দিন স্বামী সন্তানসহ জমানো কিছু টাকায় চাল ও আলু কিনে খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছেন।
শেফালি বেগম জানান, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত খাওয়ার ক”ষ্ট হলেও আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে খাবার পাচ্ছেন। সকাল বেলা কারা যেন খিচুড়ির প্যাকেট দিয়ে গেছে। দুপুরে সরকারি দলের লোকজন পরিচয়ে একটি প্যাকেট (চাল, আলু, তেল ও সাবান) দিয়ে গেছে। পোলাডা ভাত খাইতে পছন্দ করে।
সকালে খিচুড়ি খাইলেও পেট ভরেনি। চাল, আলু ও তেল পাইছিলাম, কিন্তু পু’লিশ ফুটপাতে রান্না করতে দেয়নি বলে দুপুরে পোলাডারে কিছুই খাওয়াইতে পারি নাই। তাই বিকেলে দেড় পট চালের ভাত চড়াইছি। ভাতের সাথে শাক ও ঢেঁড়শ ভাজি করে ছে’লেকে খাইতে দিবো।
এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং নিয়মিত সাহায্য না পেলে তাদের মতো হ’তদরিদ্র মানুষকে না খেয়ে ম’রতে হবে বলে জানান শেফালি। শেফালি যখন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তার ছে’লেটি বার বার এসে জানতে চাইছিল, ‘মা, ভাত খামু কহন?’